Header Ads

Header ADS

মারমা বৌদ্ধদের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় উৎসব প্রসঙ্গ গণ-প্রব্রজ্যা


ভূমিকা :
পৃথিবীতে যে দিন মানুষের সৃষ্টি হল সেদিন থেকে শুরু হল তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম। বিনাশ্রমে প্রকৃতির কাছ থেকে জীবনের অনেক উপকরণ পাওয়া সম্ভব নয়। বাঁচার তাগিদে মানুষ তৈরী করে অনেক কিছু। উদ্ভাবন করে তার জীবনযাত্রার উপায় ও কলাকৌশল। গড়ে তোলে তার সংষ্কৃতি। সেই সংষ্কৃতিগুলো সময়ের সাপেক্ষ গৌরবের ঐতিহ্য রূপে পরিণত হয়। মহামানব গৌতম বুদ্ধ ও তাঁর ধর্মত্ত্বকে ভারতবর্ষের ১৬টি মহাজনপদের মানুষ শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করেছিল এবং শরণগত মানুষগুলো জীবন ধন্য ও গৌরবান্বিত হয়েছিল। বুদ্ধের পরবর্তী তাঁর ধর্ম ভারতবর্ষে আর স্থির থাকেনি। এশিয়া, ইউরোপ দেশসহ সমগ্র বিশে^ স্বমহিমায় ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে বিভিন্ন দেশে বুদ্ধের ধর্ম প্রসারিত হলে ধর্মাচরণে ভিন্নদেশ, ভিন্ন সংস্কৃতি, বিচিত্র প্রথা-ঐতিহ্যের ছোঁয়া লাগে। এতে বুদ্ধের ধর্মদর্শন, আদর্শ অভিন্ন থাকলেও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে আচার, অনুষ্ঠানের উপকরণ ও উৎসব ভিন্ন ও বৈচিত্র দেখা যায়। বৌদ্ধদেশ গণচীনে ১০টি বৌদ্ধসম্প্রদায় ও জাপানের ১৩টি বৌদ্ধ সম্প্রদায় বুদ্ধের ধর্মতত্ত্ব ও আদর্শকে প্রতিপালন করেন। বহু সম্প্রদায় হলেও এক বুদ্ধের এক আদর্শ মেনে চলেন সবাই। বৌদ্ধ বিশ্বে এভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায় বা শাখা রয়েছে। বাংলাদেশেও বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠি রয়েছে। যেমন- বড়–য়া, চাকমা, মারমা, রাখাইন, তংচঙ্গ্যা, চাক, খিয়াং, উত্তর বঙ্গে নিউ বুড্ডিস্ট প্রভৃতি। এই সম্প্রদায় গুলো তাঁরা তাঁদের নিজস্বভাষা, সামাজিক আচার, লোকনীতি ও সংস্কৃতি ভিন্নতা রয়েছে কিন্তু ধর্ম অভিন্ন, বৌদ্ধধর্ম।
বাংলাদেশে মারমা :
পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠির মধ্যে মারমা জনগোষ্ঠি সংখ্যা বিচারে দ্বিতীয় বৃহত্তম। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে মারমাদের সবচেয়ে বেশি বসবাস রয়েছে বান্দরবান জেলায়। এ জেলায় সর্বত্র মারমাদের বসতি। খাগড়াছড়ি জেলায় দীঘিনালা উপজেলা ব্যতীত সর্বত্র মারমাদের বসতি দেখা যায়। রাংগামাটি জেলায় কাপ্তাই, রাজস্থলী, কাউখালী, বিলাইছড়ি ও রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় মারমাদের বসতি রয়েছে।
মারমাদের গোত্রসমূহ :
মারমা জনগোষ্ঠির ইতিবৃত্ত এক ও অভিন্ন হলেও আঞ্চলিক ভূগৌলিক সীমারেখার কারণে ভাষা, আচার-নীতি কিঞ্চিৎ ভিন্ন দেখা যায়। যদিও এ ব্যাপারে যথেষ্ট মত পার্থক্য রয়েছে। ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার ও গবেষক সেলিনা আহসান মারমা জাতিকে ১৫টি গোত্র করে দেখিয়েছেন। লেখক ও সাহিত্যিক মংক্য শোয়েনু একই মত পোষণ করেন। মারমাদের এই সমস্ত গোত্র মধ্যে ‘রেগ্রেসা’ এবং ‘পেলেংসা’ গোত্র দুইটি প্রধান। অন্যান্য গোত্রও শিক্ষা-দীক্ষায়, ধর্মীয় চেতনা ও সংস্কৃতির চর্চায় ক্রমবর্ধমান রয়েছে। গোত্রগুলো বোমাং ও মং সার্কেলের ভুক্ত। রেগ্রেসা গোত্রসহ আরও কিছু গোত্র বোমাং সার্কেল এবং পেলেংসা গোত্রসহ আরও কিছু গোত্র মং সার্কেল বসবাস করে থাকে।
আমার আলোচ্য বিষয় মারমা বৌদ্ধদের ধর্মীয় উৎসব গণ-প্রব্রজ্যা অনুষ্ঠান। আলোচনা করতে চেষ্টা করবো বোমাং সার্কেল আওতাধীন মারমাদের ধর্মীয় ও আঞ্চলিক রীতি অনুসারে গণ প্রব্রজ্যা অনুষ্ঠানমালা।
গণ প্রব্রজ্যা অনুষ্ঠান :
পারিবারিক জীবন ছেড়ে বৈরাগ্য গ্রহণের নাম প্রব্রজ্যা। গণাহারে প্রব্রজ্যা ধর্মে দীক্ষা প্রদানকে গণ প্রব্রজ্যা বলা যায়। প্রব্রজ্যা, ব্রহ্মচর্য বা সংসারত্যাগী বুদ্ধ ধর্মের পুণ্যসংস্কার তথা দুঃখ নিবৃত্তির অন্যতম একটি সহজ পথ। তাই প্রব্রজ্যা গ্রহণ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য অতীব গৌরবের। মারমা সম্প্রদায় প্রব্রজ্যা অনুষ্ঠানকে “সাঙ্প্রু পোওয়ে” বলে। সামাজিক প্রথা ও ঐতিহ্য দৃষ্টিতে বড়–য়া, চাক্মা বৌদ্ধদের তুলনায় মারমা বৌদ্ধদের প্রব্রজ্যা অনুষ্ঠানমালা অন্যরকম শোভামন্ডিত ও বৈচিত্র দেখা যায়। মারমাদের প্রব্রজ্যা উৎসবে রয়েছে হরেক রকমের কর্মসূচি। মারমারা প্রব্রজ্যা বা যে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান পূর্ণিমা কেন্দ্রিক উদ্যাপন করতে সাচ্ছন্দ বোধ করেন। প্রব্রজ্যা অনুষ্ঠানকে কয়েকটি ধাপে আলোচনা করা যায়। বিশেষ করে দু’দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান সূচি দেখা যায়।
প্রথম দিবস : মাঙ্গলিক অধিগ্রহণ
প্রব্রজ্যা গ্রহণ পূর্বদিন সন্ধ্যার পর থেকে মাঙ্গলিক অধিগ্রহণ পর্ব মধ্য দিয়ে প্রব্রজ্যা অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়। এ পর্বকে “মাঙ্গলা তাংগ্রং” বলা হয়ে থাকে। নিমন্ত্রিত ভিক্ষু-সংঘ পূর্বদিন থেকে উপস্থিত হন। প্রব্রজ্যা প্রার্থী তথা আয়োজকের বাড়িতে পঞ্চশীল ও অষ্টশীলসহ পবিত্র ত্রিপিটক থেকে সূত্রপাঠ আয়োজন করা করা হয়। বিহার থেকে একটি বুদ্ধমূর্তিসহ এক সংঘ (৫/১০জন) ফাঙ্ করে সম্মানের সাথে ধর্মীয় আদলে প্রভৃতি বাজনা বাজিয়ে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়ির চারদিকে সাদা সুতো দিয়ে নয় পাকে বন্ধন করা হয়। কয়েকটি পাতলা রঙিন কাগজ দ্বারা নানা কারুকার্যময় ধ্বজা তৈরী করে চাল পাঁচ পোয়া, কলা এক কাঁদি, নারকেল একটি, পান-সুপারি, টাকার নোটসহ প্রভৃতি উপকরণ দিয়ে সাজানো হয় “তারাপোওয়ে” বা “তারাবোওয়ে”। যাকে বড়–য়া সম্প্রদায় ‘পুরোহিত’ বলতে শুনা যায়। আবার রামু, কক্সবাজার বড়–য়ারা ‘থারাপওয়ে’ বলতে শুনা যায়। প্রব্রজ্যা প্রার্থী সাদা লুঙ্গি বা প্যান্ট, সাদা শার্ট, মাথায় সাদা কাপড় বাঁধানো এবং বুকে প্রব্রজিত আদলে সাদা কাপড় পরিধান করানো হয়। প্রব্রজ্যা প্রার্থীর মাতা-পিতা বা অভিভাবকগণও লুঙ্গি, থামি, সাদা শার্ট ও মাথায় সাদা কাপড় পরিধান করেন। এটি ধর্মীয় দৃষ্টিতে শুভ্র পোশাকে শুভ চেতনার রূপ। প্রব্রজ্যা প্রার্থীকে সব শ্রোতার সামনে বসানো হয় এবং ভিক্ষু-সংঘ পঞ্চশীল ও অষ্টশীল প্রদান করে পবিত্র সূত্র পাঠ শুভারম্ভ করেন। এ সময় প্রব্রজ্যা প্রার্থী ও পিতামাতা বা অভিভাবকগণ অষ্টশীল গ্রহণ করে রাতব্যাপী অষ্টশীল পালন করে পুণ্য পারমী পূরণ করতে চেষ্টা করেন। যথারীতি সূত্রপাঠ শেষে জল ঢেলে পুণ্যানুমোদন করে এ পর্ব ইতি টানতে দেখা যায়। ভিক্ষু-সংঘকে সম্মানি বা দক্ষিণাসহ প্রয়োজনীয় পানীয় দ্রব্য প্রদান করে পুনরায় সম্মানের সাথে বিহারে পৌঁছে দেওয়া হয়।

পুণ্যানুমোদন প্রথা-টাকা দান :
টাকা দান করে পুণ্যানুমোদন করা মারমা বৌদ্ধদের একটি বিশেষ সামাজিক ঐতিহ্য। আয়োজকের পক্ষ থেকে গ্রামবাসী ও আত্মীয়-পরিজনদের নিমন্ত্রণ করা হয়। আয়োজকের বাড়িতে আসার পর অতিথি বৃন্দ আয়োজকের হাতে শ্রদ্ধাদান হিসেবে ৫০, ১০০, ২০০ বা কখনো কখানো ৫০০ টাকা দান করেন। দান করার সময় দাতা ও আয়োজকের মধ্যে ছোট-বড় মান্য করে একে অপরের নমস্কার বা অভিভাদন করা হয়। প্রব্রজ্যা, সংঘদান প্রভৃতি ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াও সামাজিক বিবাহ অনুষ্ঠানেও এভাবে টাকা দান করা হয়ে থাকেন অতিথিগণ। মারমা বৌদ্ধরা এই টাকাগুলো পুণ্যানুষ্ঠান করবার জন্য দান করেন এবং দান করে তাদের পূণ্যাংশ অর্জন হয় বলে বিশ^াস করেন। এটি একটি সামাজিক সহযোগিতা ও প্রথাগত ঐতিহ্যও বটে। এতে করে সামাজিক সুদৃঢ় বন্ধন তৈরী হয় শুধু নয় পুণ্যকর্মে আয়োজক তথা পুণ্যার্থীদের মাঝেও উদারতা, ত্যাগ ও উন্নত চেতনা তৈরী করে। আয়োজকের খরচের অংকও কমে যায়। অবশ্যই মারমারা পুণ্যকর্ম ক্ষেত্রে খরচ বলতে চাই না, যদি এক লক্ষ খরচ হয় তাহলে ‘এক লক্ষ পুণ্যসঞ্চয় হয়েছে’ বলতে শুনা যায়। আয়োজক পক্ষ থেকে সবার জন্য ভাত-পানি, চা-বিস্কুট, পান-সিগারেটসহ যাবতীয় সুব্যস্থা প্রায় দুই-তিনদিন পর্যন্ত আন্তরিক আথিথেয়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে নিমন্ত্রিত ভিক্ষুসংঘের জন্যও সম্মানের সাথে আহার-বিহার, চা-বিস্কুট, পানসহ যাবতীয় সুব্যবস্থা করা হয়। এ যেন পুণ্যকর্ম উৎসবে খুশির আবহ উন্মেষ ঘটে সকলের অন্তরে।
বিনোদন ব্যবস্থা :
অনুষ্ঠানে আগত অতিথিগণের সম্মানের ও বিনোদনের জন্য আয়োজন করা হয় রাতব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যে কোন বড় অনুষ্ঠানে প্রায় সময়ই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। অন্য দশ জাতির মতো মারমাদেরও রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতির বিনোদন ব্যবস্থা। যেমন- পাংখু, জাই, ক্প্যাঃ প্রভৃতি বিনোদনমূলক বিশেষ রাতব্যাপী নাটক। এর যে কোন একটি চলতে থাকে। মারমা নাটকগুলোতে একটি গল্প উপস্থাপনের পাশাপাশি কমেডিও থাকে। এতে দর্শক ও শ্রোতাগণ চরম উপভোগ করেন শুধু নয় তাদের তন্দ্রাভাবও চলে যায় এবং নাটক দেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আবার আঞ্চলিক রুচিবোধের কারণে বর্তমানে বাংলা ভাষায় যাত্রাপালা, ব্যান্ড-শোসহ বিভিন্ন বিনোদনমূলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করতে দেখা যায়। একদিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলতে থাকে অন্যদিকে মারমাদের প্রিয় খাবার ‘মুন্ডি’ যা স্যূপ মিশ্রিত লুডল্স্ খাবার বিশেষ। হরেক রকমের জিনিসপত্র বেচা-কেনা চলতে থাকে। নাটক, খাবার ও বিভিন্নরকমের জিনিস ক্রয়-বিক্রয় এই যেন বহুমাত্রিক মেলা আয়োজন। পুণ্যকর্মের পাশাপাশি এ জাতীয় সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করতে দেখা যায়। বিনোদন ব্যবস্থা পুণ্য অনুষ্ঠানের অংশ নয় এটি সংযোজন মাত্র। পাহাড়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একটি অসুবিধা দিক্ হল মদ্যপায়ীদের দ্বারা সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা এবং কতিপয় নারী লুলোপ ও উৎশৃঙ্খল বাঙালি আগমনে মহিলা সংক্রান্ত নানা বিব্রত-বিশৃঙ্খলা হতে দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে আদিবাসী কতিপয় নারীরাও কম যায় না। অতিবিলাসী, অসচেতন ও মোহময়ী নারীরাই এমন ঘটনায় আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এই বিষয়ে গ্রাম কমিটি বা অনুষ্ঠান কমিটি বিশেষ নজর রাখা দরকার।
দ্বিতীয় দিবস ঃ প্রব্রজ্যা গ্রহণ
এ দিন হল মূল দিবস। খুব সকালে ¯œানসহ করণীয় কর্তব্য সম্পাদন করে বিহার অভিমুখে শুভযাত্রা হয়। প্রব্রজ্যা প্রার্থীকে রাজকীয় বেশ ধারণ করা হয়। যেমন-মাথায় বাঁশ বা বেতের তৈরী মুকুট, বুকে রাজকীয় এক্স চিহ্ন প্রভৃতি। আবার কাঁধে ঝুলানোা থাকে ভিক্ষা পাত্র (সেবাই), ভিক্ষুদের ব্যবহৃত পাখা, হাতে একটি দন্ডায়মান রড নিয়ে সবার সামনে ধীর পায়ে বিহার অভিমুখে যেতে থাকেন। পিতা-মাতার মাথায় ত্রিচীবরসহ অষ্ট উপকরণ, অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসীর হাতে বিভিন্ন দানীয় বস্তু ও একটি করে ধ্বজা/ধর্মীয় পতাকা বহন করে সারিবদ্ধভাবে বিহার অভিমুখে যেতে থাকেন। এতে শত শত মানুষ সমাবেশে এক বিশাল র‌্যালির মত হয়। এ সময় ব্যান্ড পার্টি বাজনা বাজিয়ে পুণ্যময় অভিযাত্রাকে আরো প্রাণবন্ত ও পুণ্যাভিলাসী করে তোলে। দেখলেই মনে হয় এক রাজা স্বপরিষদ নিয়ে বিহারে গমন করছেন। অতঃপর বিহারে পৌঁছে বিহারকে তিনবার প্রদক্ষিণ করতে দেখা যায়। এটি চৈত্য পূজা।
প্রব্রজ্যা মঞ্চ :
বিহার প্রাঙ্গণ এক পাশে একটি মঞ্চ তৈরী করা হয় যেহেতু গণ প্রব্রজ্যা মাটি তাই। থেকে প্রায় এ হাত উঁচু মাচা পদ্ধতি আদলে প্রয়োজন মত ছোট-বড় তৈরী করতে দেখা যায়। অবশ্যই যে বিহারে স্থায়ী মঞ্চ তৈরী করা আছে সেখানে আর তৈরী করা লাগে না। মঞ্চের চার কোণে প্রতিটিতে একটি করে ডাব, কলার কাঁদি, আখ ঝুলানো হয়। মঞ্চের উপরে সাদা কাপড়ের চাদোয়া টাঙানো হয়। এগুলো অবশ্যই পূর্বদিন হতে বৈরী করা হয়ে থাকে। এতে গ্রামবাসীরাই সহযোগিতা করে থাকে। প্রথমে প্রব্রজ্যার প্রাথমিক করণীয় কর্তব্য যেমন- প্রব্রজ্যার প্রার্থনা করে কেশ ছেদনের জন্য ¯œান মঞ্চে গিয়ে সম্পাদন করেন। এর মাতাপিতা, আগে আত্মীয়-স্বজনসহ উপস্থিত সবাই পঞ্চশীল গ্রহণ ও প্রভৃতি পুণ্যকর্মে অংশ গ্রহণ করে থাকেন।

কেশ ছেদন কর্ম :
প্রব্রজ্যা প্রার্থীগণ নিজ বাড়ি থেকে চুল কেটে আসে না। ভিক্ষুগণ-‘লোমা-কেসা-নখা-দন্তা-তচো, তচো-দন্তা-নখা-লোমা-কেসা’ এই কর্মস্থান দেওয়ার পর অন্য একটি ¯œান মঞ্চে গিয়ে চুল মোড়ানো ব্যবস্থা করা হয়। উল্লেখ্য, যে চুলগুলো মাটিতে ফেলে দেওয়া হয় না। প্রার্থীর যে যার মাতা-পিতা বা ভাই-বোন একটি সাদা কাপড়ে সযতেœ সংরক্ষণ করা হয়। তাঁরা চুলগুলোকে ‘ছাঈউ’ বা ‘প্রব্রজ্যা চিহ্ন’ হিসেবে বাড়িতে সংরক্ষণ করেন। মারমারা দুইটি বিশ^াসের দিক থেকে চুলগুলো সংরক্ষণ করেন। প্রথমটি, সিদ্ধার্থ অনোমা নদীর তীরে গৃহীবেশ পরিত্যাগ করে যখন চুল কেটে আকাশে উড়ে দিয়েছিলেন, সেই চুল মাটিতে আর পড়েনি। দ্বিতীয়টি হল, ছেদন করা চুলগুলো মাতা-পিতা যখন মৃত্যু হবে তখন দাহক্রিয়ার সময় এই চুলগুলোও সাথে দেওয়া হয় যাতে করে দেবদূত কাছে বলতে পারবে যে, মনুষ্যলোকে থাকতে সন্তানকে প্রব্রজ্যা ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। বুদ্ধশাসনে উত্তাধিকার চিহ্ন হিসেবে চুল দেখিয়ে পুণর্বার বুদ্ধ ধর্মে সাক্ষাৎ বা বৌদ্ধদেশে জন্মগ্রহণ করতে পারবেন। এই দুইটি বিশ^াস থেকে মারমা বৌদ্ধরা প্রব্রজ্যার চুল সযতেœ রাখা হয়। চুল মোড়ানোর পর ¯œানাদি শেষে মঞ্চে চীবর পরিধান করা হয়।
পুণর্বার প্রব্রজ্যা মঞ্চে প্রত্যাবর্তন :
কেশ ছেদন, ¯œান ও চীবর পরিধান করার পর পুণর্বার মঞ্চে ফিরে যাবার পালা কিন্তু প্রব্রজ্যা প্রার্থী ¯œান মঞ্চ থেকে পা মাটিতে ফেলা যাবে না। আত্মীয়-পরিজনের মধ্যে যে কোন ব্যক্তি (পুরুষ) প্রব্রজ্যা প্রার্থীকে খুবই আনন্দের সাথে কোলে বা পিঠে করে মঞ্চে নিয়ে যায়। অনেক সময় আত্মীয়দের মধ্যে কার আগে কে নিবে এই নিয়েও কাড়াকাড়ি দেখা যায় পুণ্য সঞ্চয়ের তরে। কিন্তু পথের কাটা হলো কৃত্রিম ‘মার’-এর উপদ্রব সম্মুখিন হতে হয়। মঞ্চে দিকে যাবার সময় গ্রামের যে কোন একজন ‘মার’ হিসেবে পথ আটকাবেন। তিনি প্রব্রজ্যা প্রাবহনকারীকে কিছুতেই যেতে দেয় না। ‘মার’ রূপ ধারণ করতে গ্রামের নাবালক ছেলেদের মধ্যে কার আগে কে অন্তরায় সৃষ্টি করবে এই নিয়েও কম দৃশ্যমান হয় না। প্রব্রজ্যার বহনকারী কৃত্রিম মারকে কিছু টাকা দেবার পর রাস্তা ছাড়বে নচেৎ নয়। আপনার কোমড় ধরে যাবে ‘মার’ তত আনন্দ পাবে তাই না? এতে দর্শনার্থী বা পুণ্যার্থী সমাবেশও কেউ কিছু বলবে না বরং এ দৃশ্য অনেক উপভোগ করতে থাকেন। ‘মার’ আক্রমণ, সেখান থেকে টাকার বিনিময়ে মারবিজয় এবং শেষ পর্যন্ত মঞ্চে পৌঁছানোর দৃশ্য দেখে অনেক আনন্দ পায় পুণ্যার্থী বৃন্দ। এটাই মারমা বৌদ্ধদের রীতি ও ঐতিহ্য। দৃশ্যটি ঐতিহাসিক প্রসূত। শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা রাতে কুমার সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ সংকল্প নিয়ে প্রভূত ঐশ^র্যপূর্ণ প্রাসাদ ও পরিবার ছেড়ে যাবার সময় ‘মার’ পথের কাটা হয়েছিল। ‘মার’ বলেছিলেন-‘রাজ কুমার, সংসার ত্যাগ করবেন না, আজ হতে সাত দিন পর ‘চক্ররতœ’ উৎপন্ন হবেন। আপনি এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠরাজা হবেন। ক্ষান্ত হয়ে প্রাসাদে ফিরে যান।’  উত্তরে সিদ্ধার্থ বললেন- ‘সে আমি জানি কিন্তু রাজচক্রবর্তীত্ব (শ্রেষ্ঠরাজা)আমি চাই না। আমি দশ সহস্র চক্রবাল ধ্বনি-প্রতিধ্বনি করে সর্বজ্ঞ বুদ্ধ হবো।’ এখানে গৃহত্যাগী সিদ্ধার্থকে ‘মার’ বাঁধা সৃষ্টি করেছিল কিন্তু মহাসত্ত্ব সিদ্ধার্থ আদর্শের কাছে নত হয়ে ‘মার’ চলে গেলেন। মারমা বৌদ্ধরা এই ঐতিহাসিক ঘটনার অনুসরণ করে থাকেন।
প্রব্রজ্যা দীক্ষা দান :
মঞ্চে ভিক্ষু-সংঘের মুখোমুখি হয়ে প্রব্রজ্যা প্রার্থীদের বসায়ে প্রব্রজ্যাধর্মে দীক্ষিত করা হয়। এতে অবশ্যই ১০ বর্ষা বা তার অধিক বর্ষীয়ান ভিক্ষুগণ মঞ্চে অবস্থান করেন। ভিক্ষু-সংঘ বিনয়-সম্মত বিধানে চীবর অধিষ্ঠান, দশশীল প্রদান, নামকরণ, গুরু নির্বাচনসহ প্রভৃতি বিনয়কর্ম সুসম্পন্ন অত:পর করেন। প্রব্রজিত নতুন শ্রমণগণ পিন্ডচারণের মতো করে পাত্র হাতে নিয়ে মঞ্চ থেকে ধীর পায়ে বিহার ভেতরে প্রবেশ করেন। এই সময় উপাসক-উপাসিকাগণ দুই পাশে দাঁড়িয়ে নব প্রব্রজিত শ্রমণদের শ্রদ্ধাদান হিসেবে টাকা-পয়সাসহ নানা প্রকার দ্রব্য দান করতে দেখা যায়। বিহারে পৌঁছে সকাল ১১টার মধ্যে সংক্ষিপ্তভাবে পিন্ডদানসহ সংঘদানের করণীয় কর্তব্য সম্পাদন করতে দেখা যায়। বিকাল ৩টা হতে প্রায় ৫ ঘটিকার পর্যন্ত বিশদভাবে ধর্মালোচনাসহ কল্পতরু দান, পুণ্য উৎসর্গ প্রভৃতি পুণ্যকর্ম সম্পাদন করে থাকেন মারমা বৌদ্ধ সম্প্রদায়। এই সমস্ত কর্মসূচি ধারাবাহিক পালনের মধ্যে গণপ্রব্রজ্যা অনুষ্ঠান পরিসমাপ্তি হয়।

গৃহে প্রত্যাবর্তন :
বৌদ্ধধর্ম জন্মান্তর বিশ^াস করে অতীত জন্মের সংস্কার কারণে মানুষ এ জন্মে অবস্থান নির্ণিত হয়। কোন ভিক্ষু-শ্রমণ জীবন ব্যাপী থাকবে কি থাকবে না এটি নির্ভর করে তাঁর অতীত পুণ্যসংস্কার ও বর্তমান জন্মে মনন শক্তি। বুদ্ধশাসন শ্রীবৃদ্ধির জন্য ভিক্ষু-শ্রমণ অবশ্যই প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দরকার সচেতন, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত ভিক্ষু। মারমা বৌদ্ধদের দেখা যায় জীবন ব্যাপী প্রব্রজিত না হলে কমপক্ষে সাত বা দশদিনের জন্য দীক্ষিত হন। যে দিন প্রব্রজ্যা বেশ ত্যাগ করে গৃহে প্রত্যাবর্তন করবে সেদিন স্থানীয় কয়েকজন ভিক্ষু-সংঘকে নিমন্ত্রণ (ফাঙ্) করে ছোট পরিসরে হলেও সংঘদান করেন। খরচের টাকা হাতে থাকলে এক মৌজা বা এক ইউনিয়নের সমস্ত ভিক্ষু-সংঘকে ফাঙ্ করে বড় পরিসরে সংঘদান করতে দেখা যায়। এ দিনে আবার  গ্রামবাসী সকলে মিলেমিশে পুণ্যকর্ম ও ভোজনাদি করতে দেখা যায়।
উপসংহার :
প্রব্রজ্যা অনুষ্ঠান প্রত্যেক বৌদ্ধ সম্প্রদায় স্মরণীয় ও বর্ণাঢ্য করতে চাই এবং হরহামশাই করে থাকেন। উপরোক্ত বিষয়ে আমি সবিনয়ে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছি মারমাদের প্রব্রজ্যা অনুষ্ঠান কতোটা বর্ণাঢ্য এবং প্রথাগত উৎসবপূর্ণ। অনুষ্ঠান পরিক্রমায় রয়েছে বৈচিত্রতা, গভীর ধর্ম বিশ^াস, প্রথাগত রীতি-নীতি, আছে গৌরবদীপ্ত ঐতিহ্য, রয়েছে ঐতিহাসিক ঘটনার সমন্বিত। সামগ্রিকভাবে বলতে হয় মারমা বৌদ্ধদের ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে অন্যতম হল প্রব্রজ্যা অনুষ্ঠান। যা লালন-পালন করে আসছে শত বছর ধরে। কোন জাতির অস্তিত্বকে জাগরণশীল, সমৃদ্ধ ও উন্নত করতে চাইলে তারা তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে কোনক্রমেই ভুলে যাওয়া উচিত নয়। এই জাতীয় ঐতিহ্যকে সযতেœ চর্চা, লালন শুধু নয় ক্ষণে ক্ষণে স্বকীয় সংস্কৃতির বিপ্লব ঘটাতে হবে। এতে করে যুব সম্প্রদায় ও নবপ্রজন্মের কাছে স্বকীয় সংস্কৃতির স্বাদ উপভোগ্য হবে। অপসংস্কৃতি ও ভিন্ন সংস্কৃতি জাতির স্বকীয়তা হারায় শুধু নয় ধ্বংসও হয় যা সহজে চোখে পড়ে না।
-সমাপ্ত-

No comments

কবিতা

অন্তপ্রাণ আমি নিঃশ্বাসের শেষ প্রাণবায়ু অনুভব করছি, যখন নশ্বর দেহে কোভিড ঊনিশ ঘ্রাণ পেয়েছি। আমি হৃদয়ের অসহায়ত্বের আর্তনাদ শুনছি, যখন ফুসফুস ...

Theme images by LUGO. Powered by Blogger.