Header Ads

Header ADS

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পার্বত্য বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী




১. প্রাক-কথন
খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান তিনটি জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম। সুদীর্ঘ ইতিহাস পালাবদলে মানুষ, সমাজ, পরিবেশ পরিবর্তনের হাওয়ায় আদিবাসী আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে। কিছু সময় কৌশলে, কিছু সময় জোর করে আবার কিছু সময় নীরবতা সুখের আশায় আদিবাসীরা ঠাঁয় পেয়েছে পাহাড়-গাত্রে। এই পাহাড় দেখতে যেমন সবুজ, গম্ভীর-নিস্তব্দ জঙ্গল এখানকার মানুষের গল্পও ঠিক এমন। দুঃখের কথা যেমন রয়েছে, আছে সুখের কথাও। কোন কোন জায়গায় রাতের জোনাকি পোকার আলো ছাড়া অন্ধকার, প্রসব বেদনারত মায়ের হাসপাতাল যেন এভারেস্ট, সেখানে শিক্ষার আলোর কিঞ্চিত। তবু মানুষগুলো শত প্রতিকূলকে আপন করে নিয়েছে। প্রতিকুল পরিবেশে বড় হওয়া কঠিন। সেই কঠিনকে বুকে নিয়ে সংগ্রাম করে চলেছে অবিরাম। ভাষা, শিক্ষা, বাসস্থান, অর্থনীতি প্রভৃতি প্রাপ্ত অধিকার সঠিকভাবে পেতে সংগ্রাম করে বেঁচে আছে। তবে আশার কথা হল, বিগত এক দুই যুগধরে কিছুটা শিক্ষার আলো পেয়েছে পার্বত্যবাসী। সরকার সুদৃষ্টি আছে তবে আর একটু আন্তরিক হলে এগিয়ে যাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম। থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম চর্চায় পার্বত্যবাসীরা অনেক এগিয়ে আছে বলা যায়। মহামানব গৌতম বুদ্ধের আদর্শ বাণী অনুসরণ করে সমাজ পরিচালনা, পূর্ণিমা ভিত্তিক ধর্মচর্চা, প্রব্রজ্যা অনুষ্ঠান এবং প্রয়াত ভিক্ষুগণের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রায় সময় সবাই মিলেমিশে উৎসব আকারে ধর্মচর্চা করে থাকে পার্বত্যবাসীরা। শান্ত-দান্ত, সভ্য-ন¤্র, ইতিবাচক সমৃদ্ধি সমাজ বির্নিমাণে ধর্মের ভূমিকা যেভাবে আছে মানুষের অন্তরের তেমন আশানুরূপ প্রতিফলন হচ্ছে প্রশাসনের ভূমিকাও।
২. বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সৃষ্টি
বঙ্গে প্রকাশিত মানচিত্রে ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের চিত্র উল্লেখ রয়েছে। অবশ্য এর অনেক আগে ৯৫৩ সালে আরাকানের এক রাজা পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চচট্টগ্রাম দখল করেন। পরবতীতে ১২৪০ সালে ত্রিপুরার রাজা এই অঞ্চল দখল করেন। আরাকানের রাজা ১৫৯৯ সালে পুনরায় দখল করে নেন এবং ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত দখল বজায় রাখেন। মুঘলরা ১৬৬৬ সাল থেকে ১৭৭৪ সাল পর্যন্ত অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করে। ১৮০০ সাল থেকে বৃটিশ শাসন ১৯৪৭ সালে গিয়ে সমাপ্ত হয়। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে আরাকান, পর্তুগিজ, মোঘল ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক রাজা-প্রজা, জমিদার দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে এই অঞ্চলের মানুষ। আরাকানের প্রাচীন ইতিহাস ‘রাখাইন রাজোওয়াং’, পর্তুগিজ মানচিত্র প্রণেতা লাভানহা অংকিত বাংলা সর্বাপেক্ষা মানচিত্রে এবং ফ্রান্সিস বুকাননের ভ্রমণ বৃত্তান্ত Francis Buchanon in South East Bengal (1798), , এই প্রামাণ্য চিত্র হতে জানা যায়, ৬ষ্ঠ হতে ১৪শ শতাব্দী হতে প্রায় ১৩টি জাতি গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে আসছে। যাঁরা আদিবাসী, উপজাতি, নৃ-তাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, Ethnic group  হিসেবে পরিচিত। যথা- চাকমা, মারমা, তংঞ্চঙ্গ্যা, চাক, রাখাইন, খিয়াং, খুমী, (কুকি) ¤্রাে, ত্রিপুরা, বম, লুসাই, পাংখোয়া, মুরং প্রভৃতি। পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালিন জেলা প্রশাসক ক্যাপ্টেন টমাস হারবার্ট লেউইন তাঁর লেখা Ò The Hill Tracts of Chittagong and the Dewllers Therein,Ó ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত বইতে লিখেছেন-‘চট্টগ্রাম জেলার সমতট ও ধানের সমুদ্র পেরিয়ে একটু ওপরে উঠে গেলেই শুরু হয়ে যায় বিশাল বিস্তীর্ণ পাহাড়ী অঞ্চল, যা দেশটির পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে রয়েছে অনেক পাহাড়ী আদিবাসীর বাস। দেশের এই অঞ্চল এবং এর অদিবাসীদের নিয়েই আমার কাজ, অন্ততপক্ষে ব্রিটিশরাজের একজন কর্মচারী হিসেবে। কাগজে-কলমে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে চিহ্নিত এই অঞ্চল ২১ ডিগ্রী ২৫ মিনিট থেকে ২৩ ডিগ্রী ৪৫ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১ ডিগ্রী ৪৫ মিনিট থেকে ৯২ ডিগ্রী ৫০ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত।’ উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে তদানীন্তন বৃটিশ সরকার ÔThe Chittagong Hill Tracts Regulation, 1900, Hill Tracts Manual’শাসনবিধি জারির মাধ্যমে আজও পার্বত্য তিন জেলাতে রাজশাসন ব্যবস্থা রয়েছে। যথাক্রমে চাকমা রাজ, বোমাং রাজ এবং মংরাজ। এরপর পাকিস্তান অত:পর ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশ। পৃথিবীর অন্য দশটির অঞ্চলের মতো সময়ের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামও দ্রুত মালিকানার হাতবদল হতে থাকে।  আশির দশকের প্রথম দিকে দেশব্যাপী প্রশাসনিক সংস্কারের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি স্বতন্ত্র জেলায় বিভক্ত করা হয়। যথাক্রমে-রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি-র সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে যা সর্বজন বিদিত।
৩. পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী সংক্ষিপ্ত পরিচয় 
পার্বত্য চট্টগ্রাম (Chittagong Hill Tracts)দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাপক পাহাড়ী অঞ্চল। দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে মায়ানমার, উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে মিজোরাম এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম জেলা অবস্থিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে এলাকা প্রায় ২৩,১৮৪ বর্গ কিমি যা বাংলাদেশের মোট এলাকার প্রায় এক দশমাংশ। এখানে বনের প্রাণী বৈচিত্র ও প্রকৃতি-পরিবেশের সাথে মানুষের সম্পর্ক আত্মিক ও খুব গভীর। বহু নদীর পারি যেমন সাগরের মোহনায় মিলিত হয় তদ্রুপ বহু জাতিগোষ্ঠী মহামিলনের ক্ষেত্র হল পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একমাত্র অঞ্চল যেখানকার অধিবাসীদের বেশীরভাগই ছিলেন অবাঙালী এবং অমুসলিম। ১৯৯১ সালে হিসাবকৃত পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ৯,৬৭৪২০ জনের মধ্যে ৪,৯৮,৫৯৫ জনই (প্রায় অর্ধেক) অবাঙালী বা পাহাড়ী। অবিশিষ্টরা সমতল থেকে আগত (মেজর জেনারেল (অবঃ) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক,-পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ-পরিস্থিতির মূল্যায়ন, পৃষ্ঠা: ১৯)। পাহাড়ে অসংখ্য বৌদ্ধ জাতিগোষ্ঠী সমন্বয়ে বসবাস। যথা- চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, চাক, ত্রিপুরা, ¤্রাে, খিয়াং, খুমী প্রভৃতি। তারা প্রত্যেকে বিভিন্ন সময় আগমন করলেও বর্ণগত মঙ্গোলীয় জাতি গোষ্ঠী এবং বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। আরাকান শাসন-১৫৯৯, মোঘল, পর্তুগিজ, ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান শাসনসহ ইতিহাস পর্যালোচনা করে বলা যায় ১৫শ শতাব্দী হতে পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বসবাস ও বৌদ্ধধর্ম প্রবেশ ঘটে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী বৌদ্ধ বড়–য়া সম্প্রদায়ও বসবাস করে আসছে বেশ কয়েকযুগ ধরে। প্রত্যেক জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ভাষা, আদব-কায়দা, পরিবার কাঠামো, রীতিনীতি, উৎসব, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য রয়েছে। পার্বত্যবাসী সাধারণত সরল দৃষ্টিভঙ্গি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম অনুসরণ করে এমন জাতিগোষ্ঠীর তালিকা দেওয়া হল।

৩. পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন বৌদ্ধ জাতিগোষ্ঠী    

৩.১ চাকমা
বাংলাদেশে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহত্তম উপজাতি জনগোষ্ঠী চাকমা। আনুমানিক ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে পর্তুগিজ মানচিত্র প্রণেতা লাভানহা অঙ্কিত বাংলার সর্বাপেক্ষা পুরাতন মানচিত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায় (বাংলাপিডিয়া)। পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্য ও উত্তরাঞ্চলেই তাদের প্রধান বসতি। ১৯৯১-এ আদমশুমারি অনুযায়ী চাকমা জনসংখ্যা প্রায় ২৫৩,০০০ হলে বিগত দশ বছর এই সংখ্যা বাড়েনি বরং কমেছে বলা যায়। শতকরা ৯০ জনেরও বেশি রাংগামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলা কেন্দ্রীভূত। সৃষ্টির আদিকাল থেকে তারা বৌদ্ধধর্মালম্বী। প্রধান উৎসব হিসেবে বিজু, বুদ্ধ পূর্ণিমা, কঠিন চীবর দান, প্রবারণা পূর্ণিমা, সংঘদান, অষ্টপরিস্কার দান প্রভৃতি উৎসব পালন করে থাকে। তাদের ঘর-বাড়ি, বিবাহ, ধর্মীয় আচার, পোষাক-পরিষদ, খাদ্য-দ্রব্যসহ সামাজিক নিয়ম নীতি চাকমাদের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণার সাথে মিশ্রিত। সুগভীর ধর্মীয় মূল্যবোধ, অধিকার আদায়ের দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সমৃদ্ধির পথে নিরলস প্রচেষ্টার চেতনা রয়েছে চাকমাদের। চাকমারা চাকমা রাজ সার্কেলে অধিভুক্ত।
৩.২ মারমা
মারমা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজাতি জনগোষ্ঠী। মগ বা মারমারা সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে প্রথম বৃহত্তর চট্টগ্রামে আগমন করে। মগ বা মারমারা প্রচীনকাল থেকে এ দেশে ‘মগ’ নামে পরিচিত। মগ নামটি ‘মগধ’ শব্দজাত (জামাল উদ্দিন-পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস, পৃ: ১৫১)।  মারমা জনগণের অধিকাংশই বাংলাদেশের তিনটি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়িতে বসবাস করে। ১৯৯১ সালে আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের মারমা জনসংখ্যা ১,৫৭,৩০১। সময় বাড়লেও এ জনসংখ্যা বাড়েনি বরং কমেছে। মারমাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। বর্ণমালার নাম ¤্রাইমাজা। মারমারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। ধর্মীয় উৎসব হিসেবে কঠিন চীবর দান, কছুংলাব্রে বা বুদ্ধ পূর্ণিমা, ওয়াছো লাব্রে বা আষাঢ়ী পূর্ণিমা, ওয়াগ্যোওয়াই বা প্রবারণা পূর্ণিমা, সাংপ্রুপোওয়ে বা গণ প্রব্রজ্যা অনুষ্ঠান, সংঘদান, অষ্টপরিস্কার দান প্রভৃতি পালন করে। প্রাবারণা পূর্ণিমা রাতে আকাশে রঙ্গিণ ফানুস উড়ানো হয়। সাংগ্রাইং সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব। এসময় বয়স্করা অষ্টশীল পালন করে, তরুন-তরুণীরা মৈত্রীজল ছিটিয়ে বর্ষবরণ ও একে অপরের মঙ্গল কামনা করে। জাপনা পোওয়ে বা প্রয়াত ভিক্ষুর সম্মানে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া একটি উল্লেখযোগ্য পুণ্য উৎসব করে। মারমা বা মগ জাতিগোষ্ঠী শান্ত-সরল, ধার্মিক জাতিগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত।
৩.৩ তঞ্চঙ্গ্যা
তঞ্চঙ্গ্যা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী একটি উপজাতি জনগোষ্ঠী। তঞ্চঙ্গ্যারা ৭৮০ মগাব্দ (১৪১৮-১৯ খ্রিঃ) গোড়ার দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান মহকুমার আলিকদম কিংবা মাতামহুরী নদী তীরবর্তী এলাকা বসবাস করে আসছে (খুরশীদ আলম সাগর, বাংলাদেশের আদিবাসীদের কথা, পৃ: ২০৬)। বর্তমানে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি জেলায় এবং কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফে তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস। তাদের নিজস্ব পোষাক ও অলংকার আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য নারীদের থেকে স্বকীয় পোশাকে তঞ্চঙ্গ্যা নারীকে সহজে চেনা যায়। তঞ্চঙ্গ্যারা প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। তবে এর বাইরে তারা বিভিন্ন দেব-দেবতা পূজা করে থাকে। তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায় অনুষ্ঠানকে ‘বিষু’ বলা হয়। 
৩.৪ রাখাইন
রাখাইন বাংলাদেশের বসবাসরত একটি উপজাতি। ‘১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে আরাকানে বিশৃংখলা ও নৈরাজ্য দেখা দিলে আরাকানরাজ থিরি থুধম্মা’র পুত্র ঙা থ্যেং খাইন আরাকান হতে নিরাপদে আশ্রয়ের আশায় বন জঙ্গলে আশ্রয় নেন। পরবর্তীতে আরাকান রাজ সভার প্রধান পরামর্শক ও রাজকুমার জ্ঞানী মন্ত্রী ঙা লাৎ রুং এর নেতৃত্বে প্রায় পঞ্চাশহাজার সৈন্য আরাকান ছেড়ে চট্টগ্রামে কেন্থা (বর্তমান কর্ণফুলি নদী) নামক স্থানে চলে আসেন। কালক্রমে উক্ত মন্ত্রী বৌদ্ধ ভিক্ষুত্ব গ্রহণ করে অ¹ামেধাবী নাম ধারণ করে কক্সবাজারে একটি জনপদ গড়ে তোলেন (মং বা অং রচিত রাখাইন রাজাওয়ান, পৃষ্ঠা: ১২)।’ বর্তমানে রাখাইনরা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাংগামাটি ও পটুয়াখালী জেলাগুলোতে রয়েছে। বাংলাদেশে রাখাইন সম্প্রাদায় যথেষ্ট এগিয়ে আছে। বিশেষত তারা ব্যবসায়ী। তারা বৌদ্ধধর্ম পালন করে। রাখাইন সাংস্কৃতিক উৎসব সমূহের ‘রাথাপোওয়ে’ বা রথোৎসব একটি অন্যতম উৎসব। সামাজিক রীতি নীতি, পোষাক পরিষদ অন্য দশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী তুলনায় আধুনিক। বর্তমান সময়ে তারা প্রায় শিক্ষিত।
৩.৫ চাক
চাক বাংলাদেশের ক্ষুদ্র আদিবাসী জনগোষ্ঠী। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার তাদের বসবাস। চৈনিক ইতিহাসে য়ূনাং এ বসবাসরত চাকদের বড় কোন জাতি বলে আখ্যায়িত করা হয়। চাকদের জীবনযাত্রা বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ঐতিহ্যমন্ডিত। শিশুর নামকরণ, বিবাহ, মৃত্যু অনুষ্ঠানের আলাদা ভাবে তাদের মতো করে উদ্যাপন করে। মূলত তারাও বৌদ্ধধর্মালম্বী। চাকদের নামকরণ, পোষাক-পরিচ্ছদ প্রায় মারমা জনগোষ্ঠীর মতো তবে ভাষা ভিন্ন রয়েছে।
৩.৬ বড়–য়া
পার্বত্য চট্টগ্রামে আর একটি বৌদ্ধ সম্প্রদায় হল বড়–য়া। বড়–য়া জাতি গোষ্ঠী অধিকাংশ বসবাস সমতলীয় চট্টগ্রামে। বর্তমানে ব্যবসায়-বাণিজ্য, চাকরি সুবাধে কিছু সংখ্যক পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায় হিসেবে তারা শিক্ষা, ব্যবসায়, অর্থনৈতিকভাবে অনেক সমৃদ্ধ। কঠিন চীবর দান, বুদ্ধ পূর্ণিমা, আষাঢ়ী পূর্নিমা, মধু পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমাসহ প্রায় ধর্মীয় উৎসব পালন করে থাকে। বড়–য়াদের বলা হয় বাঙালি বৌদ্ধ সম্প্রদায়।
৩.৭ খিয়াং
খিয়াং পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি নৃজাতি গোষ্ঠী। ১৬ ও ১৭ শতকে খিয়াংরা এদেশে আগমন করে। পার্বত্য জেলা বান্দরবান মুরারনজা পর্বতমালায় খিয়াংরা সর্ব প্রথম বসবাস শুরু করে। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে জুম চাষ করার মাধ্যমে তাদের বসতি স্থানান্তর হতে থাকে। বর্তমানে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও চট্টগ্রাম জেলায় এ জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। অতীতে খিয়াংরা ছিল প্রকৃতি পূজারি। তারা সৃষ্টিকর্তাকে বলত ‘হ্নাদাগা’। পরবর্তী সময়ে তারা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেয়। তাদের রয়েছে নিজস্ব পোষাক-পরিষদ ও অলংকার। তাদের রয়েছে প্রথাগত সমাজ নীতি।
এছাড়াও খুমী, ম্রো ও ত্রিপুরা ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠী বৌদ্ধধর্ম পালন করে থাকে। এই সমস্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায় বুদ্ধকে মনে প্রাণে অনুসরণ করে, ধর্মকে অন্তরে ধারণ করে এবং সংঘকে যথামর্যাদায় শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে থাকে। এখানে গোষ্ঠীগত বহু ও বিচিত্র হলেও বুদ্ধের ছায়াতলে সবাই শান্ত-দান্ত ও ক্ষমাশীল নীতি পালন করেন। নির্বাণ প্রত্যক্ষ প্রত্যয়ে কুশল কর্ম ও বিদর্শন অনুশীলন করে থাকেন।

৪. তাঁদের ধর্মীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ 

অরণ্য প্রকৃতির মতো সহজ-সরল, শান্ত, নিরীহ পার্বত্যবাসীরা বরাবরই উৎসবপ্রিয় হতে দেখা যায়। অভাব-অনটন, দুঃখ, অনুরাগ-অভিযোগ, অশান্ত পরিবেশ যখন মানুষকে অতিষ্ট করে তোলে ধর্মীয় উৎসব তখন বার্তাবাহন করে নিয়ে আসে  আনন্দ, শান্তি, নির্মল ও শান্ত পরিবেশ। পার্বত্য বৌদ্ধরা বুদ্ধ পূর্ণিমা পালন করে বেশ সারম্ভরে, যেমন অন্তরের শ্রদ্ধা রেখে বুদ্ধ ¯œান, বোধিবৃক্ষের জল সিঞ্চন করে প্রয়োজনীয় বৃক্ষের রক্ষণাবেক্ষণ শিক্ষা, ভিক্ষুগণের প্রতি সেবা ও আহার দান, তাঁদের নিকট উপযোগী ধর্মদেশনা শ্রবণ, উপোসথিকদের আহার দান ও যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেন শিশু-কিশোর-যুব সকলেই। যাতে মৈত্রী, সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সুদৃঢ় সম্পর্ক স্থাপিত হয়। প্রবারণা পূর্ণিমা পালন করে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে। চুলামনি চৈত্য পূজার উদ্দেশ্যে ফানুস উত্তোলনের মাধ্যমে পূজনীয় ব্যক্তিদের পূজা করা উত্তম শিক্ষা আহরণ করে থাকেন। শুদ্ধাচার ভিক্ষুদের যথাযথ মূল্যায়ন ও উত্তম দানের সমন্বয় হলো কঠিন চীবর দান যা খুবই উৎসবপূর্ণ ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ। এ সময় শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা অনুশীলনের মাধ্যমে জীবনের পূর্ণতা লক্ষ্যে সাধনায় সমাপ্ত ভিক্ষুদের জন্য পরিধেয় বিশেষ বস্ত্র ‘কঠিন চীবর’  তৈরী করেন ধর্মপ্রাণ নর-নারী। এতে করে সামাজিক মূল্যবোধ, সুসম্পর্ক, ত্যাগের মহিমা চরিত্র প্রতিফলন এবং পুণ্য চেতনায় উজ্জীবিত হন পার্বত্যবাসী। গণ-প্রব্রজ্যা অনুষ্ঠান একটি উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় উৎসব। কায়-বাক্য সংযত, সুনিয়ন্ত্রিত মন ও আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুশীলনের মাধ্যমে জাগতিক দুঃখ হতে মুক্তির অন্যতম ক্ষেত্র হলো প্রব্রজ্যা। এই অনুষ্ঠান খুবই গৌরব ও ঐতিহ্য ধারায় পালন করে থাকে মারমা বৌদ্ধ সম্প্রদায়। প্রয়াত ভিক্ষুগণের সম্মানে ও ধর্মীয় পূর্ণমর্যাদায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বা দাহক্রিয়ার অনুষ্ঠান একটি বহুমাত্রিক উৎসব। সমাজের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ এসব অনুষ্ঠানের অংশগ্রহণ করেন। জাতি, ধর্ম, গোত্রবর্ণ চিন্তা না করে এইসব ধর্মীয় উৎসবে সবাইকে উপভোগ করতে দেখা যায়। এতে করে, সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ হয়। এছাড়া সংঘদান, অষ্টপরিস্কার দান, জাদি বা চৈত্য পূজা প্রভৃতি ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করে পার্বত্য বৌদ্ধরা ধর্মীয় ও সংস্কৃতিকে ধারণ ও রক্ষা করেন। ধর্মীয় উৎসবের শিক্ষা- সম্মিলিতভাবে উৎসবে অংশগ্রহণ, নিষ্ঠা ও ঐক্যবদ্ধতার সাথে প্রয়োজনীয় কাজ করা, ঐতিহ্য ঋদ্ধ ধর্মীয় সংস্কৃতির রক্ষা, সকলের সাথে মৈত্রী ও আন্তরিকপূর্ণ সহাবস্থানে নিশ্চিত করা। ধর্মীয় উৎসব কেবল আনন্দ দান করে না, শিক্ষা দেয় অনেক কিছু। এসব অনুষ্ঠানে স্থানীয় ভিক্ষুসংঘের প্রধান সংঘনায়ক/সংঘরাজ, ভিক্ষু সমিতি, বৌদ্ধ সমিতি ও সংগঠনগুলো তত্ত্বাবধান করেন। প্রশাসনিক সংস্থা যথা-পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, তিন সংসদীয় আসনে মাননীয় সাংসদবৃন্দ, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ড পৃষ্ঠপোষক করে থাকেন। এছাড়া রয়েছে তিনটি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, তারাও সাংস্কৃতিক চর্চা, শিক্ষা, উন্নয়ন, সুরক্ষাসহ উৎসব পার্বণে সহযোগিতা করে থাকেন।       
৫. উপসংহার
পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এখানকার প্রাকৃতিক ও জীববৈচিত্রের সাথে সাথে আদিবাসীদের জীবনধারা ও সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে নানা প্রকারের বৈচিত্র। পাহাড়ের বুক চিরে সুনীল জলধারা আর অরণ্যের প্রাণছোঁয়া সবুজ এবং ১৩টি ভিন্ন ভিন্ন জাতি গোষ্ঠী একিভূত বসবাস এ অঞ্চলকে করেছে বৈচিত্র্যপূর্ণ। এ বৈচিত্র্য সুন্দর ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে সম্প্রীতির বন্ধনে। আর এ বন্ধনকে মজবুত ও আরো প্রগাঢ় করতে নীতি শিক্ষার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। বৌদ্ধ ধর্মাচরণের মাধ্যমে আমরা যে নীতি শিক্ষা পাই, তা যদি বিশ^সমাজে ছড়িয়ে দিতে পারি তাহলে বিশ^শান্তি ও সম্প্রীতি নিয়ে কোন ব্যক্তি বা জাতিকে দুঃশ্চিন্তায় পড়তে হবে না।
সমাপ্ত


গ্রন্থপঞ্জি-
১। জামাল উদ্দিন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতিহাস, ২০১৬, চট্টগ্রাম।
২। ক্যাপ্টেন টমাস হারবার্ট লেউইন, চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল ও অধিবাসী, অনু: রাজীব এল. দাস, ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ঢাকা।
৩। মং বা অং (মং বা), রাখাইন রাজাওয়ান, এপ্রিল ২০১৩, চট্টগ্রাম।
৪। শরদিন্দু শেখর চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রামের একাল সেকাল, ফেব্রুয়ারি ২০০২, ঢাকা।
৫। মেজর জেনারেল (অবঃ) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ-পরিস্থিতির মূল্যায়ন, অক্টোবর ২০১১, ঢাকা।
৬। মংসানু চেধুরী, উক্যজেন, মারমা ইতিহাস ও সংস্কৃতি, জুলাই ২০১৮, খাগড়াছড়ি।
৭। উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকা, সাংগু, ১ম-৩য় খন্ড, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট, বান্দরবান।
৮। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বিষয় ঃ বৌদ্ধধর্ম, সেপ্টেম্বর ২০১৩, কলকাতা।
৯। ড. জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায়, ত্রিপিটক সমগ্র, মহাবোধি বুক  এজেন্সী, কলকাতা।
১০। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতি, বিপ্রদাশ বড়–য়া সম্পাদিত, ফেব্রুয়ারি ২০০৩, ঢাকা।
১১। খুরশীদ আলম সাগর, বাংলাদেশের আদিবাসীদের কথা, এপ্রিল ২০১১, ঢাকা।
১২। অশ^জিৎ ভিক্ষু, পঞ্চশীল প্রসঙ্গ, ২০১৩, চট্টগ্রাম।
১৩। বাংলাদেশে জনসংখ্যা ব্যুরো-২০১১, জেলা ভিত্তিক পরিসংখ্যান, ডিসেম্বর ২০১৩।
১৪। বাংলাপিডিয়া।










             

No comments

কবিতা

অন্তপ্রাণ আমি নিঃশ্বাসের শেষ প্রাণবায়ু অনুভব করছি, যখন নশ্বর দেহে কোভিড ঊনিশ ঘ্রাণ পেয়েছি। আমি হৃদয়ের অসহায়ত্বের আর্তনাদ শুনছি, যখন ফুসফুস ...

Theme images by LUGO. Powered by Blogger.