Header Ads

Header ADS

আমার দেখা এক নিভৃত কর্মপ্রত্যয়ী অনিল কান্তি বড়–য়া (১৯৩৮-২০১৮)

আমার দেখা এক নিভৃত কর্মপ্রত্যয়ী অনিল কান্তি বড়ুয়া (১৯৩৮-২০১৮) ১ জীবনের জয়-কর্মের মাঝে। বেঁচে থাকা, বাঁচিয়ে রাখা, থরে-বিথরে জমায়িত স্মৃতি জাগিয়ে রাখা কর্মেরই শক্তি। এমনই কর্মশক্তিতে বিশ্বাসী এক নিভৃত কর্মপ্রত্যয়ী অনিল কান্তি বড়ুয়া। ২০০৭ সাল। সম্ভবত জুলাই মাস। বর্ষাবাস পূর্বে মদীয় গুরুদেব জ্ঞানরত্ন মহাথের ভান্তের সাথে হালিশহর নৈরঞ্জনা বুদ্ধ বিহারের শ্রামণ হিসেবে চলে আসি। বিহারের ভিক্ষু-শ্রামণ আগমনের সাথে সাথে বিহারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মনোরঞ্জন বড়ুয়া ও পুণ্যর্থী দায়ক-দায়িকাগণ তারিখ ভিত্তিক পালাক্রমে ছোঁয়াইং (আহার) ও প্রয়োজনীয় সুব্যবস্থা করতে লাগলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছোঁয়াইং দাতা অনিল কান্তি বড়ুয়া’র পরিবার। এরপর থেকে তাঁর ও তাঁর পরিবারের সাথে পরিচয়, হৃদ্যতা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ০৬ ডিসেম্বর ১৯৩৮ সালে জন্ম নেওয়া পটিয়া থানাধীন ঐতিহ্যবাহী বেলখাইন গ্রামের কৃতি সন্তান এই ধার্মিক উপাসক বিহার ও ভিক্ষু-সংঘকে কাছে পেয়ে শ্রদ্ধায় চিত্ত প্রসন্ন হল। অনিল বড়ুয়া বিহারে উপস্থিতি চোখে পড়ার মত ছিল শুধু নয় একজন প্রকৃত বৌদ্ধ উপাসক হিসেবে তাঁকে প্রতিটি পুণ্যকর্মে রত থাকতে দেখা গেছে। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তিনি শৈশব কাল হতে বিহার ও সমাজ কর্মে খুবই উদ্যোগী ছিলেন। ২ হালিশহর নৈরঞ্জনা বুদ্ধ বিহারে কঠিন চীবর দানোৎসবে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ হতো। তখন প্রুফ সংশোধনের কাজটি অনিল কান্তি বড়ুয়া’র হাতেই করাতেন। কেননা, তিনি বাংলা ও ইংরেজী শব্দভান্ডারে দক্ষ, প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ছিলেন। পান্ডুলিপি আনা-নেওয়া করতে গিয়ে আমার মনে একটি প্রশ্ন জাগলো তিনি কতটুকু পড়াশোনা করেছেন! পারিবারিক সূত্রে জানা যায় তিনি স্কুল গন্ডি পেরিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কলেজে অধ্যয়নকালে স্বগ্রামে শিক্ষকতা করতেন। আমার শ্রামণ্য জীবনে তাঁর এই প্রতিভা দেখে সেইদিন আমার মনে উচ্চ শিক্ষার আকাঙ্খার বীজ বপন হয়েছিল। আসলে, মানুষকে বিকশিত করার মূলে যে প্রতিভা তার শক্তি সত্যই বিস্ময়কর। এই সমাজকে নানাভাবে যাঁরা সমৃদ্ধ করেছেন তাঁরা হলেন প্রতিভাধর এবং তাঁদের হাতেই রয়েছে আগামী দিনের সম্ভাবনা। অনিল কান্তি বড়ুয়া ছিলেন প্রতিভাদীপ্ত আলোকিত অগ্নিশিখা যা তিনি জীবনের গতি পথে আলো ছড়িয়েছেন। ৩ তিনি ভগবানের উপর ভরসা করে হাত-পা ঘুটিয়ে বসে থাকার পাত্র নন, তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের জীবনই অনন্ত শক্তির উৎস। তিনি মনে রেখেছিলেন-‘এড়ফ যবষঢ় ঃযড়ংব যিড় যবষঢ় ঃযবসংবষাবং” তাই তিনি কর্মজীবনে ১৯৬০ সালে এক শিপিং কোম্পানিতে যোগদান করে সংসারের হাল ধরেন। তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে সাফল্যের সাথে ৩০ বছর চাকুরি জীবন শেষ করে ১৯৯৭ সালে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। চাকুরী জীবনে অত্যন্ত সৎ ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করে সহকর্মীদের প্রিয়ভাজন হয়েছিলেন। ৪ উপার্জন ও কর্মতৎপরতার জন্য বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জ হতে শহরে ছুটে আসা বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী তেমন ঐক্যবদ্ধ ছিল না, ছিল না নিয়মিত ধর্মচর্চা। বুদ্ধ ভাষিত সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম অনুসরন করতে গিয়ে সেই সময়ে অনিল কান্তি বড়–য়া মহৎ হৃদয়বৃত্তি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর বৌদ্ধ কর্মজীবি কল্যাণ পরিষদ এর সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি চট্টগ্রাম বন্দর বৌদ্ধ বিহার বাস্তবায়ন আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকর্মী ছিলেন। পরবর্তী উক্ত সংগঠনের সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়ে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীদের ঐক্যবদ্ধতা ও ধর্মচর্চার সুপরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন। এছাড়াও বেলখাইন জনকল্যাণ পরিষদ, অনোমা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠি (১৯৯৩-১৯৯৫), গণতন্ত্র পার্টি, হালিশহর নৈরঞ্জনা বুদ্ধ বিহার পরিচালনা পরিষদ, বাংলাদেশ সমাজ সংষ্কার আন্দোলন, চট্টগ্রাম মহানগর বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদসহ বহু সংগঠনের সম্পৃক্ত থেকে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, জ্ঞাতী সকলকে বহু মঙ্গলকর্মে উৎসাহিত করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে বুদ্ধ বলেছেন- “দান দেওয়া, ধর্মাচরণ করা, জ্ঞাতি বর্গের হিতাসাধন করা ও সদ্ধর্মের অপ্রমত্ত থাকা-এটাই উত্তম মঙ্গল।” (মঙ্গল সুত্তং, খুদ্দক নিকায়) ৫ ধার্মিক লোকেরা নিত্য দিনের পরিশুদ্ধি জীবনাচরণ পাশাপাশি ধর্মীয় তথ্যানুসন্ধান করতে চাই। বুদ্ধের বিচরণ ভূমি লুম্বিনী, বুদ্ধগয়া, সারনাথ ও কুশিনগর এই চার মহাস্থান শ্রদ্ধাভরে দর্শন করলে সদ্গতি লাভের হেতু উৎপন্ন হয় (মহাপরিনির্বাণ সুত্তং)। অনিল কান্তি বড়–য়া তাঁর জীবনে চার-চারবার তীর্থস্থান দর্শন করেছেন। তিনি সর্বশেষ ২০১৬ সালে পবিত্র বুদ্ধভূমি ভারত-নেপাল তীর্থ করেছিলেন এবং বুদ্ধগয়ায় প্রব্রজ্যা ও ভিক্ষুত্বধর্মে বরণ করে পরিশুদ্ধি আচরণের মাধ্যমে নির্বাণের পথ প্রশস্ত করেছেন। তিনি সন্তানদেরকেও প্রব্রজ্যাধর্মে দীক্ষিত করে পিতৃত্ব ধর্ম পালন করেছিলেন। তিনি প্রান্তিক ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট এর এককালীন ৫০,০০০/- টাকা অনুদানসহ বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে উদার মনে দান করে দানাদি পারমী পূর্ণ করতে সচেষ্ট ছিলেন। এমনই পুণ্যকর্মে সহযোগী ছিলেন তদীয় সহধর্মীনি, রতœগর্ভা সুনন্দা বড়–য়া। ৬ পিতা-মাতা যদি ভাল কিছু করে সন্তানরা গর্বিত হয়, তদ্রুপভাবে সন্তানগণ ভাল কিছু করলে পিতা-মাতাও গর্বিত হয়। এই অনুরূপ বাক্যটি অনিল কান্তি বড়–য়া পরিবারের সাথে ভাল মানিয়েছে। অনিল বড়–য়া’র কর্মগুণে আজ তাঁর সন্তানরা অবশ্যই মাথা উঁচু হয়েছে, তদ্রুপভাবে সন্তানগণ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজ সদ্ধর্ম বিকাশে নানাভাবে অবদান রেখে চলেছেন। ১ম সন্তান প্রীতিময় বড়–য়া লাভলু-এমএ (রাজস্ব কর্মকর্তা), ২য় সন্তান স্মৃতিময় বড়–য়া টিপলু-বি.কম, বি.পি.এড (শিক্ষক ও ব্যবসায়ী), ৩য় সন্তান মৈত্রী বড়–য়া মামনি-বি.এ.(অনার্স)-আমেরিকা প্রবাসী, ৪র্থ সন্তান দীপ্তিময় বড়–য়া নোবেল-এমএ (খাদ্য অধিদপ্তরে কর্মরত)। এটাকে বলে-‘বাপকা বেটা সিপাইকা ঘোড়া কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া।’ ৭ লেখালেখিতে অনিল বড়–য়া’র দক্ষতা পরিলক্ষিত হয়। তিনি বৌদ্ধ প্রবন্ধ, কবিতা লিখতেন নিয়মিত। আমার পঠিত তাঁর সর্বশেষ কবিতা বৌদ্ধ ম্যাগাজিন ‘নৈরঞ্জনা’ মাঘী পূর্ণিমা সংখ্যা-২০১৮ এর প্রকাশিত “বুদ্ধের অন্তিম ঘোষণা” কবিতাটি বেশ চিত্তাকর্ষক। তিনি আত্মশক্তিতে বলীয়ান এক সচেতন বর্ষীয়ান নাগরিক, মেধাবী, স্পষ্টভাষী, পরিশ্রমী ও সুসংগঠক ছিলেন। এই অনন্ত চরাচরে কেউ চিরস্থায়ী নয়। সমাজ হিতৈষী নিভৃত কর্মপ্রত্যয়ী মানুষটি আমাদেরকে ছেড়ে অন্য লোকভূমিতে পাড়ি জমান ১৩ই ফেব্রুয়ারী-২০১৮ তারিখে (অনিচ্চ বত সঙ্খারা....)। আজ অনিল কান্তি বড়–য়া সম্মুখে না থাকলেও তাঁর আদর্শ ও কর্মগুণে তাঁর জীবনালো দীপ্তিমান হয়ে থাকবে। জীবনচরিতের মধ্যে আদর্শ মানুষের জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিক চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়। তাঁর জীবনের নানা প্রবাহের বিবরণ রূপায়িত হয়ে ওঠে। জীবনচরিত থেকে পাঠক যদি যথার্থ শিক্ষা অর্জন করতে পারে তবেই জীবনচরিত পাঠ সার্থক হয়। পুণ্যদান করি, মহানুভবতা ও মহৎ কর্মের সিক্ত বীজ নির্বাণ অবধি ফল-ফুলে বলীয়ান হোক, সুখ-সমৃদ্ধি যেন অবিচ্ছেদ্য অংশ হোক। ‘জয়তু বুদ্ধ সাসনম্ জয়তু অনিল কান্তি বড়য়া’

No comments

কবিতা

অন্তপ্রাণ আমি নিঃশ্বাসের শেষ প্রাণবায়ু অনুভব করছি, যখন নশ্বর দেহে কোভিড ঊনিশ ঘ্রাণ পেয়েছি। আমি হৃদয়ের অসহায়ত্বের আর্তনাদ শুনছি, যখন ফুসফুস ...

Theme images by LUGO. Powered by Blogger.