কলা গাছের ভেলায় দেড় ঘন্টা
তারিখ টা চৌদ্দ জুলাই, সাল দুইহাজার ঊনিশ। সময় সকাল সাড়ে নয়টা।
নতুন বৌদ্ধ বিহারে থাকতে নিজ গ্রাম থেকে বালাঘাটা কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ বিহারের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছি। রেনিং পাড়া বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ উ. পাইন্দাওয়েংসা থের আর আমি। আমাদের যাত্রার বাহন মোটর সাইকেল। পাহাড়ে ইদানিং মোটর বাইকই একমাত্র গাড়ি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন যাত্রী বাহী গাড়ি নেই আর আমার মোটর সাইকেলে চড়া তেমন অভ্যাস নেই, ঠিক করে বসতে পারি না। পথে রাবার বাগান আর সবুজ প্রকৃতি। বহুদিন পর বনপ্রকৃতি দেখে খুব ভাল লাগ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় নতুন জুম চাষ চল্ছে। কোন গাছ-গাছালি নেই, তবে নব অঙ্কুরিত চারা আর আগাছাগুলো আমাকে অনেক আকর্ষণ করেছে। যদিও যাচ্ছি একটু সংশয় নিয়ে, কি যেন কি হয়! আকাশে ঘণ মেঘরাশি, কখন যে বৃষ্টি পড়বে অজানা। বৃষ্টিতে ভিজ্তে আমার ভাল লাগে কিন্তু সাথে বই আর কাপড় থাকাতে এই ইচ্ছা পূরণ না হওয়াই ভাল। এমনিতে সপ্তাহব্যাপী বৃষ্টিতে সারা দেশ বন্যায় প্লাবিত হয়ে একাকার। এ কথা ভেবে যাচ্ছি মোটর বাইকে। পথে অনেক পাড়া-গ্রাম ফেলে এসেছি। বালাঘাটা আগের শেষ পাড়া তুংক্ষ্যং। গ্রামটি মোটামোটি ভাল। উঁচু নিঁচু পাহাড়ে প্রায় পঁচাশটির বেশি পরিবার আছে। এই পাড়াটি পার হতেই দেখতে পেলাম বিশ-ত্রিশ জন লোক জড়ো করে বন্যার পানি দেখছে। আমরা মোটর বাইক থেকে নামলাম। আমাদেরকে দেখে সেখানকার লোকজন বললেন -‘ভান্তে, আপনারা যেতে পারবেন না। পানিতে ডুবে গেছে রাস্তা। কেউ কেউ বল্ছে পানি এতই যে এক বাঁশ পর্যন্ত মাটির তল ম্পর্শ পায় না। আমরা বুঝে নিলাম পানির গভীরতা। ১২-১৫ ফুট গভীর হবে। আমরা আর অপেক্ষা করেনি। ফিরে গেলাম তুংক্ষ্যং পাড়া বৌদ্ধ বিহারে। হঠাৎ অতিথি আমরা। সেখানে দুপুর আহার খেয়ে নিলাম আমরা তিন জন। খাবার মেনুতে আমার অত্যন্ত প্রিয় দু’টি খাবার পেয়ে গেলাম। এক সজনা পাতা রান্না আর অপরটি বাঁশ কোড়ল ঝাল ভোনা। বৃষ্টির ঠান্ডা হাওয়ায় আর বাঁশ কোড়ল ঝাল ভোনা, খেয়ে নিলাম পেট ভরে। বিহারের শ্রমণ, সেবক আর পাড়ার তিনজন লোক বেশ আন্তরিকতার সাথে রান্না-বান্না করে আমাদের আপ্যায়ন করলেন। একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায়, মারমা সমাজে বৌদ্ধ বিহারের খাবার নিয়ে কোন রকম কম শব্দটি নেই। খাওয়া শেষ। ইতোমধ্যে আমার পূর্ব পরিচিত তুংক্ষ্যং পাড়াবাসী দু’জন ছেলে বিহারের আসলেন এবং দেখা করলেন আমার সাথে। মংবাথোয়াইং আর গড়াউ মারমা। তারা বললো-‘আমাদের কলা গাছের ভেলা আছে, চলুন! আমরা আপনাদের পৌঁছে দিই।’ নিরাপদে পৌঁছে দেবার প্রত্যয়ে ওরা সাহস দিল আমাদের। আমরাও ভাবলাম যেতেই হবে যখন আর দেরি না করে চলে যাই। তাদের সঙ্গে আমরা তিনজনই গেলাম। একজন স্থানীয় ভান্তে, আমার গ্রামের বিহারের ভান্তে আর আমি। কলা গাছের ভেলায় বসলাম। কলা গাছের ভেলাটি এমন যে, তিনজনের বেশি বসা যাবে না। দু’জন হলে ভাল। কিছু মহিলা বল্ল-‘ভান্তে! আপনারা যেতে পারবেন না। ডুবে যাবেন। অন্যদিন যান, এই বন্যায় এমন কি যাওয়া জরুরী??। কারো কথা না শুনে আমরা তিনজন ভেলায় বসলাম। আমরা ভেলার উপরে আর চালক দু’জন ভেলার নিচে পানিতে। একজন টানছে অপরজন পিছন থেকে ঠেল্ছে। যতদূর যাই ততই মনে হচ্ছে পানির গভীরতা বাড়ছে। চালকেরা আর পায়ের র্ম্পশ পায় না মাটি। ভেলা একটু একটু নড়ছে আর মনে হচ্ছে এই বুঝি ডুবে যাচ্ছি। আমি সবচেয়ে ভয় পাচ্ছি কেননা, ভেলায় উঠা এই প্রথম আমার জীবনে। অনভিজ্ঞতার কারণে আমি নড়াচড়া করছি একটু বেশি। নানা সংশয় আর ভয় নিয়ে পাড় হচ্ছি বন্যায় কবলিত রাস্তা আর মাঠ-ঘাট। রাস্তার যেটুকু অংশ ডুবেছে খুব বেশি হলে হাফ কিলোমিটার হবে, হয়তো। গাড়িতে হলে দশ মিনিটের পথ তা ভেলায় চড়ে দেড় ঘন্টায় পাড় হলাম। খরচ হিসেবটা এরকম। দশ টাকা নয়, গুণে গুণে চারশত টাকা দিতে হল। তবে কষ্ট লাগেনি। দেড় ঘন্টা ধরে তারা পানিতে ডুবেছে আর আমাদের টেনেছে। ধন্যবাদ তাদের।
পৌঁছে গেলাম আমার গন্তব্যস্থল-বালাঘাটা কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ বিহারে।
No comments
Post a Comment