মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রতিফলনমূলক অনুশীলন -এর প্রয়োগ ও কার্যকারিতা
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রতিফলনমূলক অনুশীলন -এর প্রয়োগ ও কার্যকারিতা
ভূমিকা
শিক্ষক এবং প্রশিক্ষকের জীবনে পেশাগত সফলতা লাভের জন্য নিয়মিত প্রতিফর অনুশীলন একান্ত অপরিহার্য। প্রতিফলন হচ্ছে যে কোন শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে একটি বহুমুখী উৎস সম্বলিত প্রকৃত পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ। এটি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য তাদের অভিজ্ঞতাকে শক্তিশালী করা বা বাড়ানোর জন্য একটি অতি প্রয়োজনীয় পদ্ধতি।
প্রতিফলন অনুশীলন
সাধারণত প্রতিফলন অনুশীলন বলতে কোন কিছুর ঘটে যাওয়া রূপের পর্যালোচনা করে নদুনভাবে কার্য সম্পন্ন করার ক্রম উদ্যোগকেই বোঝানো হয়। অর্থাৎ কোন ব্যক্তির আগে সম্পন্ন করা কার্যাবলিকে ডায়েরিতে লিপিবদ্দ করে তার ত্রটি বিচ্যুতি পর্যালোচনা করে নতুনভাবে কার্য সম্পন্ন করার ক্রমাগত প্রচেষ্টাকেই প্রতিফলন অনুশীলন Reflective Practice বলে।
ডোনাল্ড শন (Donald Schon) প্রতিফলন অনুশীলন বা Reflective Practice-এর ধারণাটি ১৯৮৭ সালে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে কারও দক্ষতা অর্জনের প্রক্রিয়া হিসেবে প্রথম ব্যবহার করেন। ডোনাল্ড শন প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী ÒReflective
Practice involves thoughtfully considering one’s own experiences in applying
knowledge to practice while being coached by professionals in the disciplineÓ
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রতিফলন অনুশীলনের প্রয়োগ কৌশল
প্রতিফলন অনুশীলন বিভিন্ন তত্ত্বের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য এবং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পরীক্ষা করার জন্য বিশেষ পদ্ধতির যোগান দেয় যা উপরোক্ত কর্ম করতে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করে। প্রকৃতপক্ষে প্রতিফলন ঘটে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যাতে আরও বিমূর্ত ধারণাকে বোঝার মতো মানসিক সামর্থ্য তৈরি হয় এবং নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে কর্মে পরিবর্তন আনা যায়। প্রতিফলন ব্যতীত পেশাগত উন্নয়ন খুব কম ঘটে থাকে। Could and Taylor (1996) এর মতে, ব্যবস্থাপনা উন্নয়নমূলক সমস্যা সমাধানের জন্যও প্রতিফলন পদ্ধতির গুরুত্ব অপরিসীম। এই প্রতিফলন ও বিশ্লেষণের প্রক্রিয়া শনাক্তকরণের সময় মনোযোগের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এ থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের জীবনে ও ক্যারিয়ারের অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রসারিত হতে পারে।
শিখন স্টাইল বা শিখন রীতি
একজন শিক্ষকের প্রতিফলন দেখা যাবে তার শিখন স্টাইল বা শিখন রীতিতে। শিখন ব্যাপারটিই মূলত: শেখার ও বোঝার বিষয়। তাই গভীর অনুসন্ধানের চেয়ে এর প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে বোধগম্যতাই বেশি প্রয়োজন। শিখনের জন্য কোন একক ও সঠিক পথ যেমন নেই, তেমনি শিখনের জন্য কোন পদ্ধতিকেই খারাপ বলা যায় না। শিক্ষক যদি নিজে জ্ঞান সমৃদ্ধ হন, তবে যে কোন পদ্ধতি ব্যবহার করেই তিনি পাঠদান কার্যক্রমকে সার্থক করে তুলতে পারবেন। যদিও শিখন রীতি বা স্টাইল সম্পর্কে অনেক তত্ত্ব রয়েছে, তথাপি নিচের ৩টি রীতিকে মৌলিক শিখন রীতি হিসেবে গণ্য করা যায়। যেমন-
১) দৃশ্যমান শিখন রীতি: লিখিত তথ্য (যেমন: নোট, ডায়াগ্রাম ও ছবি ইত্যাদির মাধ্যমে শিখন)।
২) শ্রবনযোগ্য: বক্তব্য প্রধান (শিক্ষক বক্তৃতা দেন ও শিক্ষার্থীরা শোনে)।
৩) স্পর্শ গ্রাহ্য: স্পর্শ, চলাচল ও স্থান (অনুকরণ এবং অনুশীলন)
শিক্ষণ রীতি বা টিচিং স্টাইল
শিখনের মতো শিক্ষণের জন্যও কোন একক স্টাইল ব্যবহার না করে বিভিন্ন শিক্ষণ রীতি বা টিচিং স্টাইল ব্যবহার করা শ্রেয়। নিচে Tony Grashon এর চারটি টিচিং স্টাইল এর উল্লেখ করা হলো :
১) নিয়মানুগ কর্তৃপক্ষ (Formal Authority): এ ধরনের শিক্ষণে শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকের সংশ্লিষ্টতা কম থাকে। তারা শিক্ষক-শিক্ষার্থী এমনকি শিক্ষার্থী-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের প্রতিও উদাসীন থাকে। শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাদানের সময় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন মনে করেন না।
২) Facilitator (সাহায়তাকারী): এ ধরনের শ্রেণীকক্ষে গ্রুপ ওয়ার্ক করানো হয়। শিক্ষার্থীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করে থাকে। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই সমস্যা সমাধান করতে পারে।
৩) Demonstrator (প্রদর্শক): এ ক্ষেত্রে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নতুন নতুন শিখনরীতি প্রদর্শন করতে উৎসাহিত করে।
৪) Delegator (কর্মকর্তাগণ): এ ক্ষেত্রে শিক্ষকগণ শ্রেণীকক্ষে কিছু শিক্ষার্থীর মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতা অর্পণ করে থাকেন যাতে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি হয়ে যে কোন কাজ সম্পাদন করতে পারে। তবে সব ধরনের শিক্ষণ রীতিতেই (Teaching Style) মেটাফোর (Metaphores) ব্যবহারের দক্ষতা থাকতে হবে যা দিয়ে কোন বিমূর্ত বিষয় বা জিনিসকে মূর্ত বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে তথ্য পরিবেশন করা হয়ে থাকে।
প্রতিফলনমূলক অনুশীলন -এর কার্যকারিতা
আমাদের পেশাগত জীবনে প্রতিফলন অনুশীলনের মাধ্যমে পেশাগত সফলতা অর্জনের অনেক কর্মপরিকল্পনাই বাস্তবায়িত হয় এবং কার্য সফলতা লাভের পথ সুগম হয়। নিচে এ প্রতিপলন অনুশীলনের কার্যকারিতার কয়েকটি দিক উপস্থাপন করা হল-
১। প্রতিফলন অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যক্তি দক্ষ হয়ে উঠে।
২। এটি পেশাগত উন্নয়নের একটি পথ।
৩। নিজেকে ক্রমাগতভাবে শোধরানোর একটি পরিকল্পিত পথ হল নিয়মিত প্রতিফলন অনুশীলনকরণ।
৪। এর মাধ্যমে পেশার সাথে সাথে সেবা করার একটি উন্নত মানসিকতা তৈরী হয়।
৫। ভালভাবে পেশাগত সেবাদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
৬। ব্যক্তি পর্যায় হতে প্রাতিষ্ঠানিক সফলতার প্রভাব দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসে।
৭। ব্যক্তির কাজ এবং পেশাকে সার্থক ও সফল করে তোলা যায়।
৮। ব্যক্তিগত মাধ্যমেই নির্ধারিত সমস্যার সমাধানের পথ উন্মুক্ত করে তোলা যায়।
৯। ব্যক্তির মাঝে আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয়।
১০। নিজেই নিজের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন।
উপসংহার
বাস্তব অবস্থায় প্রেক্ষাপটে বলা যায় প্রতিফলন অনুশীলন আমাদের কর্মজীবনে সার্বিক সফলতা বয়ে আনার অন্যতম একটি সূচক। এর ব্যবহারিক গুরুত্ব অনেক। সুতরাং আমাদের পেশাগত জীবনের উন্নয়নের জন্য নিয়মিত প্রতিফলন অনুশীলন করা আবশ্যক।
সমাপ্ত
সহায়ক গ্রন্থ তালিকা
২। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বি,এড. শিখন, মূল্যযাচাই ও প্রতিফলনমূলক অনুশীলন-২, ঢাকা।
২। ড. শেখ আমজাদ হোসেন, শিখন, মূল্যযাচাই ও প্রতিফলনমূলক অনুশীলন, প্রভাতী লাইব্রেরী, ঢাকা।
৩। ড. সাধন কুমার বিশ্বাস ও মিসেস সুনীতা বিশ্বাস, শিক্ষা মনোবিজ্ঞান ও নির্দেশনা, প্রভাতী লাইব্রেরী, ঢাকা।
৪। মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম,-শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি, খায়রুন প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারী, ২০০৬, ঢাকা।
No comments
Post a Comment